Wednesday, February 16, 2011

দেশের বিশ্বকাপে তৈরি দেশ


আগামীকাল সন্ধ্যায় রিকশায় চড়ে বিশ্ব প্রদক্ষিণ করতে বেরোচ্ছে বাংলাদেশ!
রিকশা নামের এই ত্রিচক্রযান মধ্যবিত্তের কাছে যদিও এখনো স্বস্তির, কিন্তু উচ্চবিত্তের কাছে বিরক্তি। যানজট ঘটায়, গাড়ির রাস্তায় বাধা। কিন্তু এসব ছাপিয়ে এ রিকশাই আগামীকাল ইতিহাসে ঢুকে যাচ্ছে বাংলাদেশের পরিচয়ের সূচক হয়ে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে জমকালো করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই, খরচাপাতি হচ্ছে, গান-বাজনার বহু আয়োজন; কিন্তু সেসব তো সব দেশের, সব খেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই থাকে। কিছু দেশজ সংস্কৃতির প্রদর্শনী, গানে গানে কিছু আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ। বাংলাদেশের বিশেষটা কী? এই রিকশা। ১৪ দেশের অধিনায়করা রিকশায় চড়ে মাঠে ঢুকবেন আর বাংলাদেশ সেই রিকশার অদৃশ্য যাত্রী হয়ে পেঁৗছে যাবে বিশ্বের দেশে-দেশে। মাঠে ঢোকার খবরটা আর সব ছাপিয়ে এমন কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে যে সন্ধ্যায় এক বিদেশি সাংবাদিক ফোনে খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, সেই রিকশাগুলো আছে কোথায়! সৌভাগ্যবান রিকশাওয়ালাই বা কারা! তাঁর দেশের পত্রিকা সম্ভবত এগুলোর ছবি-পরিচয় এসব চায়। আমাদের রিকশা আজ এতটাই মর্যাদাকর!
বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের কিছু পরিচিতি আছে। যথারীতি সেগুলো আপত্তিকর। বিশ্বমিডিয়ায় বাংলাদেশ সাধারণত খবর হয় গোলমেলে ঘটনায়। কখনো বন্যায় ভেসে, কখনো মৌলবাদীর বোমা হামলায়, কখনো আবার দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে। তা এটাই যেহেতু পরিচিতি, কাজেই পৃথিবীর মানুষ ধরে নেয় বাংলাদেশের সব জায়গায় বোধ হয় সব সময় হাঁটুপানি থাকে। বোধ হয় আমাদের সবার একেকটা নৌকা আছে এবং আমরা সাঁতার কেটে এখান থেকে ওখানে যাই। দুর্নীতির বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার সূত্রে কেউ কেউ মনে করে বাংলাদেশে বোধ হয় চুরি-ডাকাতিই চলে শুধু। এ সবই চলে, কিন্তু এগুলোর চেয়ে এ দেশে এখন অনেক বেশি চলে ক্রিকেট। এতটাই যে এর ছায়ায় ঢাকা পড়ে বাংলাদেশ এখন আর দুর্নীতি-অভাব-সমস্যাগ্রস্ত দেশ নয়, বাংলাদেশের পরিচয় ক্রিকেটের দেশ। ক্রিকেট বিশ্বকাপের এক নম্বর আয়োজক! ভারত-শ্রীলঙ্কা সহ-আয়োজক বটে, কিন্তু বাংলাদেশ তাদের অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। এবং এর কৃতিত্ব আপনার। কারণ, আপনি রাত জেগে টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। আপনি এখনো টিকিটের জন্য হাপিত্যেশ করছেন। ভারত-শ্রীলঙ্কায় কিন্তু অত উচ্ছ্বাস নেই। এখনো টিকিট পড়ে আছে। শ্রীলঙ্কার তো নাকি কিছু মাঠ ফাঁকা থাকারই আশঙ্কা। শুরুতে যখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাংলাদেশকে দেওয়া হয় তখন মনে হয়েছিল, এটা আমাদের প্রতি আইসিসির একটা বিশেষ দয়া। কিন্তু আজ বিশ্বকাপ যখন দরজায় তখন জোর গলায় বলতে পারি, এটা সুযোগ নয়, অধিকার। আমাদের মতো বিশ্বকাপকে অতটা নিজের করে তো আর কেউ নেয়নি। বিশ্বকাপ ইতিহাসেই আর কোনোদিন কোথাও অত মাতামাতিও বোধ হয় হয়নি। যত সহ-আয়োজকই থাকুক, যতই ভারত মানে ক্রিকেটের দেশ হোক, এই বিশ্বকাপ আয়োজনে আমরাই এক নম্বর।
আয়োজনে বাংলাদেশ প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই উৎসাহী। একবার ন্যাম সম্মেলন পর্যন্ত আয়োজন করতে গিয়েছিল। এক যুগ আগে এই বিশ্বকাপের মিনি আদলটাই হয়েছিল বাংলাদেশে, বিরাট ক্রিকেট মেলা, কিন্তু বাংলাদেশ নিজেরাই নেই। এখন ভাবলে খুব হাস্যকর লাগে, তখন কিন্তু অতটা লাগেনি। কারণ তখনকার বাংলাদেশ তো অংশ নিলে শোভা বাড়ার চেয়ে কমত, বিশাল বিশাল হার আর লজ্জার কিছু রেকর্ড হতো। কিন্তু এক যুগ পর এই বিশ্বকাপের আগের আবহসংগীতটা এমন যে তাতে এমনকি বাংলাদেশের বিশ্বজয়ের সুর পর্যন্ত আছে। এখনই বাড়াবাড়ি কল্পনা, কিন্তু এটা তো আর বাড়াবাড়ি নয় যে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে একটা গোনায় রাখার মতো দল। অঙ্ক উল্টে দেওয়ার সামর্থ্যে বলীয়ান। আয়োজনের এই অপরূপ রূপের সঙ্গে সাকিবদের শক্তির দ্যুতি মিলছে এক বিন্দুতে। আর তাতে বাংলাদেশ সত্যিই বিশ্বকাপের রঙে রঙিন।
ঢাকা শহরটাকে মাঝে-মাঝে অচেনা লাগে যেন! রূপকথার অসুন্দরীরা যেমন মায়াবী হাতের ছোঁয়ায় ডানাকাটা পরী হয়ে যেত কিংবা বৃদ্ধের শীর্ণ শরীরে তারুণ্য ভর করত জাদুর কাঠির স্পর্শে, সেসব জাদুর কাঠি যেন রূপকথা থেকে বেরিয়ে ঢাকাকে সৌন্দর্যে ভরপুর করার কাজে ব্যস্ত। ইউরোপিয়ানরা চমকাবে না, উপমহাদেশীয়রা হয়তো বড়জোর বলবে, বাহ! বেশ তো! কিন্তু আমরা তো জানি_আমাদের এই ঢাকার, এই চট্টগ্রামের এটুকু বদলই কী বিশাল অগ্রগতি। মিরপুরের রাস্তা মানেই এখন আর কোমরের ওপর দিয়ে ধকল বয়ে যাওয়া নয়, স্টেডিয়ামগুলো নতুন রূপসজ্জায় এমন অপরূপ যে অনেক দিনের পুরনো কোনো দর্শক ঢুকে ভাবতে পারেন, জাদুর গাড়িতে চড়ে ইউরোপ-আমেরিকার কোনো মাঠে চলে যাননি তো! বিশ্বকাপটা এমনই অদৃশ্য জাদু-যান হয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে চলছে গৌরব আর পরিচিতির নতুন সৌধে।
জাদুর যান কল্পনায়। বাস্তবে রিকশা। রিকশায় চড়ে বাংলাদেশ যখন বিশ্বভ্রমণে তখন তো আবার আরেকটা চুম্বকটানে পুরো পৃথিবী বাংলাদেশের দিকে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট নামের মাদকতা পৃথিবীকে নিয়ে আসছে বাংলাদেশে। দুয়ে মিলে...
কাল আমরাই ক্রিকেট পৃথিবীর মধ্যমণি।

No comments: